Monday, May 7, 2012


তোমার মন্ত্রে / মেঘ অদিতি



উপনিষদের মত জীবন তোমার 
শান্ত, সৌম্য, আড়ম্বরশূন্য। আজো 
দেখি অতিথিশালার সবচেয়ে ছোট 
পুবমূখী ঘর আর খোলা বারান্দার
হু হু হাওয়ার তুমি শান্তিনিকেতন। বিন্দু 
থেকে ব্রাহ্মমুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ো বৃহত্তর
আমির ভেতর। নত তুমি, তুমি ধ্যানী
মঙ্গলধারায় জেনেছো ঐক্যের উপলব্ধি
রহস্য জেনেছো আলো থেকে আলো 
জ্বালাবার। স্মিতমুখে বলো সৃষ্টির কথা 
বলো চিত্ত দিয়ে দেখো দেখো দেখো .. 
ধ্যানমগ্নতায় জ্বেলে দাও সে আলো
যার ভেতর দিয়ে হেসে খেলে ঢুকে 
পড়ে ভোরের সবটুকু রোদ, শ্রাবণধারা
তুমি ও তোমার মন্ত্র তাই চিরসুন্দরে
শান্তং শিবং অদ্বৈতম!



পঁচিশে বৈশাখ / অলক বিশ্বাস

হৃদয়ে প্রেম এলে কোকিলেরা এসে চুপি চুপি
পাতায় পাতায় লেখে ভালোবাসা 
কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে ফোটে বৈশাখে। 
তুমি আসবে বলে
সকালের সূর্যটা সামনে দাঁড়ায়।

একদিন চৈত্রে তুমি ছিলে
মনে পড়ে, একদিন এসেছিলে বৈশাখে
ধুলোর মাটিতে বৃষ্টি নেমেছিলো।

আজও এসেছো কবি,
শঙ্কায় স্বপ্ন কাটাকুটি
দেনায় পুড়ছে সমবায় 
ভাগচাষী-বর্গা কেঁদেছে অনেক
তোমার গানে আজকে অশ্রুপাত...

জোতদার সাজায় তোমাকে
পঁচিশে বৈশাখ

পঁচিশে বৈশাখ / ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
আবার এলো সে ফিরে। 
অজস্র অজস্র ফুল, শ্বেত শুভ্র মালা 
সুগন্ধে সুরভিত আকুল বাতাস 
ছুঁয়ে যায় প্রান, মন গানের মূর্ছনে
অগণিত জনতার পঁচিশে বৈশাখ...

কাতারে কাতারে ঢল জোড়াসাঁকো গৃহে 
অলিন্দে, গবাক্ষে উঁকি মারে বিচিত্রা আলয়ে
যার যত ছবি আর শিল্পকর্ম আছে, সব নিয়ে আসে 
পবিত্র নামাজের মত মাটিতেই বসে পড়ে বিকোতে থাকে 

শিশুদের নাচগানে মুখরিত পথ
গৃহস্থের প্রাঙ্গনে আলপনা আঁকা
তোমারই রচিত গীতে,তোমারই সুরেতে
মাতোয়ারা হয়ে আছে ভক্ত জনগণ 
শ্রবণে, মননে আজো সেই মধ্যমণি
বাঙ্গালীর হৃদয়ের তুমি রবি-কবি।


তাঁর কথায় : কবিতা ও ছন্দ ও কাব্য-ভাষা (‘সাহিত্যের স্বরূপ’ রচনা থেকে সংকলিত)


কবিতা ব্যাপারটা কী, এই নিয়ে দু-চার কথা বলার ফরমাশ এসেছে ... কবিতা জিনিসটা ভিতরের একটা তাগিদ, কিসের তাগিদ সেই কথাটাই নিজেকে প্রশ্ন করেছি । যা উত্তর পেয়েছি সেই কথাটা সহজ করে বলা সহজ নয় ।


গোড়াতেই গোলমাল ঠেকায় ‘সুন্দর’ কথাটা নিয়ে । সুন্দরের বোধকে বোধগম্য করা কাব্যের উদ্দেশ্য এ কথা কোন উপাচার্য আওড়াবামাত্র অভ্যস্ত নির্বিচারে বলতে ঝোঁক হয় , তাতো বটেই । প্রমাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ধোঁকা লাগায়, ভাবতে বসি সুন্দর বলে কাকে ?... এইরকম সংশয়ের সময়ে কবির নাণী মএ পড়ে। Truth is beauty, অর্থাৎ সত্যই সৌন্দর্য । কিন্তু সত্যে তখনই সৌন্দর্যের রস পাই, অন্তরের মধ্যে যখন পাই তার নিবিড় উপলব্ধি – জ্ঞানে নয়, স্বীকৃতিতে । তাকেই বলি বাস্তব ...।


বিষয়ের বাস্তবতা উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর একটি দিক আছে, সে তার শিল্পকলা । যা যুক্তিগম্য তাকে প্রমাণ করতে হয়, যা আনন্দময় তাকে প্রকাশ করতে চাইযা প্রমাণযোগ্য তাকে প্রমাণ করা সহজ, যা আনন্দময় তাকে প্রকাশ করা সহজ নয় ।


শেষ কথা হচ্ছে, truth is beauty, কাব্যে এই ট্রুথ রূপের ট্রুথ, তথ্যের নয় । কাব্যের রূপ যদি ট্রুথ রূপে অত্যন্ত প্রতীতিযোগ্য না হয় তাহলে তথ্যের আদালতে সে অনিন্দনীয় প্রমাণিত হলেও কাব্যের দরবারে সে নিন্দিত হবে ...।


ভাবগতিকে বোধ হয়, আজকাল অনেকের কাছেই বাস্তবের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘যা-তা’কিন্তু আসল কথা, বাস্তবই হচ্ছে মানুষের জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজের বাছাই করা জিনিস । সেই বিশ্বব্যাপি যা-তা থেকে বাছাই হয়ে যা আমাদের আপন স্বাক্ষর নিয়ে আমাদের চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়ায় তারাই আমাদের বাস্তব । ...


পাড়ায় মদের দোকান আছে, সেটাকে ছন্দে বা অছন্দে কাব্যরচনায় ভুক্ত করলেই কোন কোন মহলে সস্তা হাততালি পাওয়ার আশা আছে ...। আমার বলার কথা এই যে , লেখনির জাদুতে কল্পনার পরশমণিস্পর্শে, মদের আড্ডাও বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, সুধাপানসভাও । কিন্তু সেটা হওয়া চাই । অথচ দিনক্ষণ এমন হয়েছে যে, ভাঙ্গা ছন্দে মদের দোকানে মাতালের আড্ডার অবতারণা করলেই আধুনিকের মার্কা মিলিয়ে যাচনদার বলবে ‘হ্যা, কবি বটে’, বলবে ‘একেইতো বলে রিয়ালিজম’ । আমি বলছি,বলে না । রিয়ালিজমের দোহাই দিয়ে এরকম সস্তা কবিত্ব অনেক অত্যন্ত বেশি চালিত হয়েছে । আর্ট এত সস্তা নয় ......কাব্যের লক্ষ্য হৃদয় জয় করা – পদ্যের ঘোড়ায় চড়েই হোক, আর গদ্যে পা চালিয়েই হোক । সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির সক্ষমতার দ্বারাই তাকে বিচার করতে হবে । ... ছন্দে লেখা রচনা কাব্য হয়নি, তার হাজার হাজার প্রমাণ আছে, গদ্যরচনাও কাব্য নাম ধরলেও কাব্য হবেনা তার ভুরি ভুরি প্রমাণ জুটতে থাকবে


ছন্দের একটা সুবিধা এই যে,ছন্দের স্বতই একটা মাধুর্য আছে; আর কিছু না হয় তো সোটাই একটা লাভ । সস্তা সন্দেশে ছানার অংশ কম হতে পারে কিন্তু অন্তত চিনিটা পাওয়া যায় । ..আসল কাব্য জিনিসটা একান্তভাবে ছন্দ অছন্দ নিয়ে নয়, তার গৌরব তার আন্তরিক সার্থকতায় ।


গদ্যই হোক, পদ্যই হোক রচনামাত্রেই একটা স্বাভাবিক ছন্দ থাকে । পদ্যে সেটা সুপ্রত্যক্ষ , গদ্যে সেটা অন্তর্নিহিত । সেই নিগূঢ় ছন্দটিকে পীড়ন করলেই কাব্যকে আহত করা হয় । পদ্যছন্দবোধের চর্চা বাঁধা নিয়মের পথে চলতে পারে, কিন্তু গদ্যছন্দের পরিমাণবোধ মনের মধ্যে যদি সহজে না থাকে তবে অলঙ্কার-শাস্ত্রের সাহায্যে এর দুর্গমতা পার হওয়া যায়না । অথচ অনেকেই মনে রাখেন না যে, যেহেতু গদ্য সহজ, সেই কারণেই গদ্যছন্দ সহজ নয় । সহজের প্রলোভনেই মারাত্মক বিপদ ঘটে, আপনি এসে পড়ে অসতর্কতা । অসতর্ক লেখকের হাতে গদ্যকাব্য অবজ্ঞা ও পরিহাসের উপাদান স্তুপাকার করে তুলবে, এমন আশঙ্কার কারণ আছে । কিন্তু এই সহজ কথাটা বলতেই হবে, যেটা যথার্থ কাব্য সেটা পদ্য হলেও কাব্য, গদ্য হলেও কাব্য । ….


তর্ক এই চলছে , গদ্যের রূপ নিয়ে কাব্য আত্মরক্ষা করতে পারে কি না । ... এখন তর্কের বিষয় এই যে, কাব্যের স্বরূপ ছন্দোবদ্ধ সজ্জার ‘পরে একান্ত নির্ভর করে কি না । কেউ মনে করেন, করে ; আমি মনে করি করে না । অলঙ্করণের বহিরাবরণ থেকে মুক্ত করে কাব্য সহজে আপনাকে প্রকাশ করতে পারে,... ।


কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে ; তাকেই বলে ছন্দ ।গদ্যের বাছবিচার নেই, সে চলে বুক ফুলিয়ে । সেইজন্যেই রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি প্রাত্যহিক ব্যাপার প্রাঞ্জল গদ্যে লেখা চলতে পারে । কিন্তু গদ্যকে কাব্যের প্রবর্তনায় শিল্পিত করা যায় । তখন সেই কাব্যের গতিতে এমন কিছু প্রকাশ পায় যা গদ্যের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতীত । গদ্য বলেই এর ভিতরে অতিমাধুর্য – অতিলালিত্যের মাদকতা থাকতে পারে না । কোমলে কঠিনে মিলে সংযত রীতির আপনা-আপনি উদ্ভব হয় । ......

গুরুদেব : লহ প্রণাম / অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়


উদ্ধৃত করিতেছি কাকে ?
তিনি আমার মনের শান্তি, প্রাণের আরাম ।

তো খুব স্বাভাবিক যে হাত কাঁপবে ;
মূর্ছিতপ্রায় হবে অন্তঃকরণ ।
লোপ পাবে করণ, কর্ম, অধিকরণ ।
ঠাকুর, সখা যে হাওয়ায় মিশে ;
শ্রাবণের নিঠুর প্রলাপ অতিক্রম করে ।
বোশেখের পল্লবের রঙে,
তাঁর দৃষ্টি, তাঁর প্রেমময় কল্পভ্রুণ ।
মরমে মরমে পশিয়াছে উদার,
আধ্যাত্মের অন্তিম পুরুষের অভ্যর্থনা ।
বিহানক্ষণে উদাত্ত বৈতালিক অথবা,
পথের দাবী, প্রভাতফেরীতে ।
গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থে কি অপূর্ব সমন্বয় ;
আশ্রমে মন্দ্র নাদ মুখরিত সেতারে ।
অহমহীন বান্ধবময় বিনত জ্ঞানবৃক্ষ ;
ভগবান, শয়তান ; সবার সমাধিকার ।

বোশেখের ২৫তম দিনেঃ
এ দিন আজি কোন ঘরে গো
খুলে দিল দ্বার ।

 আমার রবীন্দ্রনাথ

লাবণ্য কান্তা

আমার সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথ, তাঁকে বাদ দিয়ে
আমার কিছুই হয়ে উঠেনা।
যখন হাসি তখনো রবীন্দ্রনাথ,
যখন কাঁদি তখনো তিনি
যখন জন্ম তখনো তিনি,
যখন মৃত্যু তখনো তিনি।
আমি তাঁকেই ভালোবাসি,
তাঁকেই ভালোবেসে-বেসে
আমার একলা পথ চলা।
তিনিই আমায় বারে-বারে বলেন,
এই পৃ্থিবীর কেউ হয়না তোর আপন,
কেউ যে নয় পর ; সবাইকে তুই আপন ভাবিস
তুই থাকিস সবার পর
তাইতো আমি থাকি সবার পর,
হইনা কারও আপন
সেও এক ভীষন ভ্রান্তি আমার
কালের সমুদ্দুর
সকাল কাটে রবি ঠাকুর ভেবে,
বিকেল কাটে ভুল, সন্ধ্যা কাটে
মিছে মায়ায় ... রাতটুকু আবার ভুল
আমার আমি মিছেই হয়তো, শুধু রবি ঠাকুর
সবটাই আমার আপন ভাবার ঘোর  

অবিনশ্বর বিশ্বকবি / অনুপম দাশশর্মা

মু্দ্রিত নয়নে জাগ্রত বাঙ্গালীর ঈশ্বর
সার্ধ শতক দিগন্ত
বৈশাখে মত্ত বসন্ত
পৌরুষ প্রকোষ্টে সৃষ্ঠ প্রভাকর নশ্বর।

আপামর বাঙ্গালীর শ্বাস-প্রশ্বাসে এক সত্তা
সহজপাঠে হামাগুড়ি
ভাষায় দ্রুত হাতেখড়ি
নিসর্গ সহচরী সাহিত্যে পরম বাগদত্তা।
উদাসী শৈশব কতই না উজ্জল গ্রন্থে
পিটুনি ছাতের সাথে গান
কলিকাতা স্বপ্নে চলমান
শিশুখুশী উদ্বেল বহমান নদীঘাট প্রান্তে।

আনন্দ সহজাত মুক্ত মনেরই উপবন
বন্দিত বৃক্ষ চাষে
পৌষ নবান্ন হাসে
আঁচল পাতা মাটি নিষ্ঠায় 'শ্রীনিকেতন'

বৈশাখ ২৫শে শ্রদ্ধার বিনম্র চিত্র
গুরুদেব বিশ্ব বরেণ্য
সুন্দর সত্য প্রণম্য
বিশ্ব কবির দান বঙ্গের সনাতন মিত্র।

চাবিওয়ালা / অমিতাভ দাশ

কতো রকম ঝোলাই তালা
কতো দেওয়াল আড়াল রাখি
এলেন আমার "চাবি-ওয়ালা"
কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি!
----
"
এই নে দিলাম বৃষ্টি-চাবি
শ্রাবন-ঘন গহন মোহে
এই নে রাখ এই প্রেমের চাবি
সেদিন দুজনে দুলবি দোঁহে"
----
"
সুখের চাবি এই যে দিলাম?
খুলবি যত দুঃখ-তালা
ক্ষমার চাবি রাখিস বুকে
হিমবাহর বরফ গলা"
----
"
স্বর্গ-ছলনা ছলনা কেন?
স্বর্গ মোদের ভিতর-ওয়ালা
গীতবিতানে চাবির তোড়া
দেখনা কোনটা খোলে সে-তালা!"
----
গানের চাবি, আলোর চাবি
ভাঙলো দেওয়াল ভাঙলো তালা
যে রাতে মোর দুয়ার ভেঙে
এলেন আমার "চাবি-ওয়ালা"!

রবির চিঠি / রত্নদীপা দে ঘোষ

নতুন বৌঠান কেমন আছো তুমি
আকাশের দেশে ?
এখনো কি গাঙ শুনতে পাও আমার তারাদের আশে পাশে
আর কি ভালোবাসো আমায় নতুন বৌঠান ?
কতদিন হয়ে গেছে
কতদূর চলে গেছো
স্থির তবু যৌবন ! একই ভাবে প্রশস্ত বেলাভূমি
দুকূল তার যায়না দেখা
স্রোতে ভাসা সেই সীমান্তরেখা
আমার অলিন্দ আমার নিলয়
কত কথা, বিস্তীর্ণ হৃদয়
আমার তুলি রঙে আঁকা
দেবদারু বনভূমি ।

মনের সমস্ত শুদ্ধি শাড়ির আঁচলে
লুকোনো তোমার উপাসনা রূপ
যতবার বন্ধ করি চোখ
ছুঁয়ে দাও তুমি
বড়ো অবাধ্য তোমার ধূপধুনো চুল
ভিজে বকুলের গন্ধ, পাশে বসতে হেসে
কথা হীন, কথা কাহিনি
এলোমেলো কবিতার কোলাহল
আর শব্দের পাগলামি ।
নীরবতা ছুঁই তোমার বিশল্যকরণী আঙুল
গীতবিতানে চোখ মেলে কতো গান
বৌঠান, গীতাঞ্জলী তো তোমারি নাম ।
নতুন বৌঠান
আমার সকাল ঘুম থেকে উঠতোনা
আমার অলস মধ্যাহ্ন বিশ্রাম নিতোনা
আমার একলা রাত ঘুমোতোনা
যদিনা তুমি
পদাবলী হয়ে পাশে থাকতে ।
মনে আছে তোমার দোলনায় পাশাপাশি বসে গান গাওয়া
যামিনীও তখন মধুমাখা ছিলো
ছিলো নীলচে রঙের হাতধরা ভোর
দুজনের মাঝখানে
ঘুম ঘুম চোখ আর
রোমাঞ্চ, চাদর
আমরা একসাথে কতোদিন গুনেছি
বৌঠান, কতো গান সেধেছি
কতো স্বপ্নের প্রহর ।
আলতা পরা পা দুখানি
জোড়া কাঁকন
রেখছি সুরক্ষিত
একান্ত নির্জন তোমারি শান্তি নিকেতনে ।

চলে গেছো বহু দিন
এখন আমার চশমাপরা বৃদ্ধ বিকেল ।
একটু দূরে
আমলকী ছাতিম দু বোনে চায়ের আসর ।
মনে হ’লো
ওদের পাশে তুমি যেন বসলে হঠাৎ ।
হাসলে অকারণ, কিশোরী উচ্ছল
বহুযুগ আগে গঙ্গার বুকে
তেমনি তুমি ভরা ঢেউ ছলছল ।
সেদিনও খোয়াইয়ের ধারে
দেখেছি যেন তোমায় ।
চাদের হাসি ভেঙ্গেছে বাঁধ
জ্যোৎস্নার দল এলো ভীড় কোরে
তোমার পায়ের নীচে খেয়া পার করে
সোনার তরী ।

নতুন বৌঠান, তুমি কেমন আছো, ভালো তো ?
আছো তো তুমি
আমার শেষের কবিতায় ?

বিশ্বকবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি /মানস বিশ্বাস
            ভালো সাঁতার জানি বলে একটু গর্ব ছিল অনেক জলাশয়ে , অনেক নদ-নদী-ঝিল, এমন কি সাগরসঙ্গমেও সাঁতার কেটেছি। জলে ভেসে বেড়ানোর সেইসব অভিজ্ঞতা গর্ব ভরে অনেককে শুনিয়েওছি,যদিও নিদর্শন হিসাবে কিছুই সংগ্রহ করিনি। করলে হয়তো বয়ে আনা যেত, নোংরা দূষিত জল, নদীতে ভেসে থাকা চিতার আধপোড়া কাঠ, কিম্বা বেওয়ারিশ পচা গলা শবদেহ।
            প্রাণভরা অভিজ্ঞতা আর মনভরা অহঙ্কার নিয়ে একদিন রবীন্দ্র সরোবরে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল পূর্বের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি করে ফিরে আসা। কিন্তু জলে নেমে মনে হল এখানে কেন্দ্রের আকর্ষণ বড়ই তীব্র। অভিজ্ঞ সাঁতারুর পক্ষেও ভেসে থাকা অসম্ভব। অতএব ডুবসাঁতারের জন্য ডুব দিলাম। রবীন্দ্র সরোবর যে এত গভীর,আর এত মণিমুক্তায় ভরা, তা তো আগে জানতাম না। সেই থেকে ডুবেই আছিওঠার ইচ্ছাও নেই,ক্ষমতাও নেই। মণিমুক্তার জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছি।
            আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে অনেক সময় বুঝতেই পারিনা কোনটা মায়া মোহ-র বন্ধন,আর কোনটাই বা প্রকৃত মুক্তি। অর্থের খোঁজে পরমার্থকে হারিয়ে ফেলি। স্বার্থরক্ষা করতে গিয়েই বোধহয় জীবনটা শেষ পর্য্ন্ত বেশী ব্যর্থ হয়। কিন্তু সত্যিকারের মুক্তির হদিশ আছে রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, যা তাঁর লেখায় প্রকাশিত
           আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনার-ই আবরণ !
খুলে দেখ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দ নিকেতন।।
মুক্তি আজিকে নাই কোন ধারে,আকাশ সেও যে বাঁধে কারাগারে,
বিষনিশ্বাসে তাই ভরে আসে নিরুদ্ধ সমীরণ।।...
শূণ্য করিয়া রাখ তোর বাঁশী,বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি-
ভিক্ষা না নিবি,তখনি জানিবি ভরা আছে তোর ধন।।

ইস্পাতের ছুরির বদলে সোনার ছুরি দিয়ে আঘাত করলে ব্যথা কম লাগে এ কথা বুদ্ধিগ্রাহ্য না হলেও হৃদয়গ্রাহ্য তো বটেই, অভিনব কিছু পাওয়ার আনন্দ বা অহঙ্কার কষ্ট লাঘব করতে সাহায্য করে। তাই হয়তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে না ,মুক্তির জন্য ছটফট ও করছি না।
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
সহস্র বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ…”
            গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতই রবি ঠাকুরের পূজার মন্ত্রও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁরই রচনার মধ্যে। ভাবতে অবাক লাগে যে, রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি পাতায় কত না বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে।কোন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ,সমালোচক,কিংবা পন্ডিত ব্যক্তিও আজ পর্যন্ত এমন দাবি করেন নি যে তিনি রবীন্দ্রনাথের সব লেখা পড়েছেন। আসলে সেটা যে সম্ভবই না। কেননা,আজও নানাসূত্র থেকে তাঁর কত অপ্রকাশিত লেখা ক্রমাগত প্রকাশিত হচ্ছে,কে জানে আরো কত মণিমুক্তা কোন পাতালের গভীরে লুকিয়ে আছে ! তাই বলি, রবীন্দ্র সরোবরের গভীরতায় দমবন্ধ হয় না, বরং সিন্ধুর ওই অতল তলেই আছে অমৃতের  অসংখ্য বিন্দু
সে / শর্মিষ্ঠা ঘোষ 

যখন মরাখাতের সম্পর্কগুলোর রেটিং করি 
যখন কোন মানচিত্রে স্থায়ী ঠিকানা থাকে না 
যখন কারও জবানিতে শুধু হারিয়ে যাই রোজ 
তখনো কিছু চেনা জানা শেকড় গাড়ে অবহেলে 
কিছু ভালোলাগা বট বৃক্ষের মত ছায়া দেয় 
বোধের সহজ পাঠে মায়ের গানে পরশ পেয়েছিলাম তাঁর 
বাবার কণ্ঠে ছবি হয়ে এসেছিলো তাঁর সৌম্য ঋষিরূপ 
রাজাধিরাজ সে ,আসন ছড়াল রন্ধ্রে রন্ধ্রে , 
জীবন খাতায় মলাট দিলাম তাঁর গানের স্বরলিপি
যেখানে মৃত্যু বিষাদ রহিত , জন্ম চির বাঙময় 
যেখানে শান্তি সীমাহীন চরাচরে অবশ্যম্ভাবী তাঁর যাদুতে 
এখন আমার মেয়েকে চেনাচ্ছি , সেই অবাক পাড়ার গলি
অক্ষরে অক্ষরে সুরে তালে সে প্রবাহিত হচ্ছে কড়ি কোমল নিষাদে ধৈবতে...

রবি ঠাকুর - তোমাকে প্রণাম / অর্পিতা দাশগুপ্ত

আমার হৃদয়ের গহনে তুমি
হে কবি , রবি ঠাকুর ।
পুজো করতে চেয়েছি তোমায়
ফুলে মালায় ।
নির্বাক দেবতা নও
তুমি আধার সকল রসের
আনন্দে, প্রতিটি ক্ষণে

জীবনের মধ্যযামে
তোমারি আরতি হোক
চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে ...

আমার নয়ন তব নয়নের নিবিড় ছায়ায়
কথার কুসুমকোরক খোঁজে...।

সেই অন্বেষণেই পথ চলা
দিশাহীন জীবনে
তুমি স্থির ধ্রুবতারা ।

জীবন সায়াহ্ন কালে
তুমি থেকো , মোর সনে
চিরজনমের কবি হে আমার 
তোমাতেই আমার মরা-বাঁচা ।



তোমার সুরের ধারা / ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়



একশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ আগামীর কবিকুল যারা আমাদের গান শোনাবেন, তাদের আগাম অভিবাদন জানিয়ে আশা ব্যক্ত করেছিলেন –

...আজি হতে শতবর্ষ পরে

এখন করিছে গান সে কোন নূতন কবি

তোমাদের ঘরে ।

আজিকার বসন্তের আনন্দ অভিবাদন

পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে



‘আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে’ একশ বছর আগে কবির এই আশা যে শুধুমাত্র তাঁর কাব্যিক আবেগ ছিলনা, সেকথা আজ আর নতুন করে বলার বিষয় নয় । এই অস্থির সময়কালে আমাদের সর্বপ্রকার মানবিক উপলব্ধির এবং পভীরতর জীবনবোধের আমৃতসন্ধান আছে তাঁর গানে প্রখর প্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন – তিনিই বলতে পেরেছিলেন যে, বাঙালি সুখে- দুঃখে তাঁর গানই গাইবে , সচেয়ে স্থায়ী হবে তাঁর গান । তিনি বলতে পেরেছিলেন কারণ বাঙ্গালি-মনন সম্পর্কে তাঁর ভাবনা সহস্র যো্জন অগ্রগামী ছিল । আমাদের মনের মুক্তি ঘটানোর জন্য বাংলাগানেরও মুক্তি ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ‘গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধে ভাসে’ – এ উচ্চারণ শুধু তাঁর একটি গানের কলি মাত্র নয়, আমাদের মনের মুক্তিরই মহামন্ত্র । তাই তাঁর জন্মের দেড়শবছর পরেও আমাদের সব জিজ্ঞাসা, সব সুখ-দুঃখ, বিষাদ-বেদনার থেকে উত্তরণের ঠিকানা রয়েছে তাঁর গীতবিতানের দুইসহস্রাধিক গানের অক্ষরে । তিনি অনুভব করেছিলেন ‘আত্মপ্রকাশের জন্য বাঙালি গানকে অত্যন্ত করে চেয়েছে’ । বাঙ্গালির গানকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন ‘নির্জন এককের গান’ রূপে, তাঁর কথায় ‘আমার গান ঘরের মধ্যে মাধুরী পাওয়ার জন্য’ ।

          

বাংলাগানের উদ্ভব শাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে হয়নি । মধ্যযুগে  ইসলামী শাসনকালে সঙ্গীত যখন রাজদরবারে আবদ্ধ, সেই সময়কালে সমন্বয়ী সংস্কৃতির প্রভাবে শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাঙালির প্রথম সাংস্কৃতিক নব্জাগরণ ঘটেছিল, সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালির আপন গান – কীর্তন । তারপর ভরত চন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুবাবু, দাশরথী রায় প্রমুখ বাঙালির আপন গানের ধারাটিকে বেগবান করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলাগানের সেই শিকড়ের কাছে গেলেন । বাঙালি কোনদিনই শাস্ত্রীয় গান বা সেই গায়নরীতিকে আপন করে নেয়নি, বরং বাংলাগান আধুনিক হয়ে উঠলো তার নিজের পথে, বলা ভালো রবিন্দ্রনাথের হাত ধরেই বাংলাগানের আধুনিক হয়ে ওঠা । বাংলাগানের আধুনিক হয়ে ওঠাকে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ করলেন এইভাবে – ‘গানকে ভালোবেসেছে বলেই, সে গানকে আপনহাতে আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরী করতে চেয়েছে । তাই আজ হোক কাল হোক বাংলাগান যে উৎকর্ষ  লাভ করবে সে তার আপন রাস্তাতেই করবে,আর কারো পাথর পাথর জমানো বাঁধা রাস্তায় করবে না’ । রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা গানের যে নির্মিতি তার মূলে আছে এই বিশ্বাস – তাঁর সংগীত দর্শনের মূল সত্য । শাস্ত্রীয় সংগীতের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতবিদ যদুভট্ট তাঁর বাল্যের সংগীত শিক্ষক হওয়া সত্তেও শাস্ত্রীয় সংগীত তাঁকে কিছুমাত্র আকর্ষণ করেনি, তিনি ফিরে গিয়েছিলেন বাংলা গানের শিকড়ের কাছে ।

কেমন গান ছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে - তাঁর জন্মকাল ও শৈশবে ? পাঁচালি গানের জনক দাশরথী রায়ের মৃত্যুর পরের বছর জন্ম রবীন্দ্রনাথের । তাঁর শৈশবকালে ছিল পাচালি , কবিগান, বিদ্যাসুন্দর পালার গান, হাফ-আখড়াই ইত্যাদি । ১৮৭২এ সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রতিষ্ঠার সূত্রে থিয়েটারের গানের যে প্রাবল্য দেখা দিয়েছিল সেগুলির বাণী ও সুর রচিত হ’ত এই ধরণের গানের ধাঁচে । সম্পন্ন অভিজাত শ্রেনির মানুষের মধ্যে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা ভিন্ন বাঙালির বিনোদন মূলক সাংগীতিক রুচি তখন কীর্তনাঙ্গের গা্ন, দেহতত্ব, প্রেম ও ছলনামূলক গান কিংবা মোটাদাগের হাসির গানে । রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বাংলাগানে নন্দনের প্রতিষ্ঠাভূমির নির্মাণ । কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা পত্রে বলেছিলেন ‘গান যখন জাগে মনের মধ্যে তখন চিত্ত অমরাবতীতে গিয়ে পৌঁছায় । চিত্তের মুক্তির অন্বেষণই তাঁকে বিভোর করেছিল গানের মধ্যে ।

তিনি কিভাবে দেখেছিলেন তাঁর কালের বাংলা সাংগীতিক প্রতিবেশকে ? কেন তিনি চেয়েছিলেন বাংলাগানকে যথার্থ আধুনিক করে তুলতে ? রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন ‘আমাদের শিল্প সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা আমরা হারাইয়াছি । আমাদের জীবনের সঙ্গে তাহার যোগাযোগ নিতান্তই ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছে । নদীতে যখন ভাঁটা পড়ে তখন পলি বাহির হইয়া পড়িতে থাকে । আমাদের সংগীতের স্রোতস্বীনিতে জোয়ার উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে বলিয়া আজকাল তাহার তলদেশের পঙ্কিলতার মধ্যে লুটাইতেছি’ ...এদেশে যখন প্রথম কলেরগান বা গ্রামোফোন প্রচলিত হ’ল (১৯০২)রবীন্দ্রনাথ তখন চল্লিশ পেরোন পরিণত । কলেরগানই যে বাংলাগানকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছে দেবে এটা বুঝে তিনি কলেরগানের সেই প্রথম যুগেই নিজকন্ঠে গান ধ্বনিবদ্ধ করেছিলেন ও শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যাদের দিয়ে গান করিয়েছিলেন । মনে রাখতে হবে, সেকালে মেয়েদের গান করাকে সমাজ অনুমোদন করতোনা ।

আমাদের পরম বিস্ময় এই যে, রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এমনকি তাঁর প্রয়াণের কিছুকাল পরেও তাঁর গানের অন্তর্দীপ্তি বাঙালিকে তেমন ভাবে টানেনি । কেন টানেনি সে অন্য প্রসঙ্গ । রবীন্দ্রনাথের গান প্রথমে ব্রাহ্মসমাজ  এবং শান্তিনিকেতন ও জোড়াসাঁকোর পারিবারিক পরিবেশের গান , তারপর সম্পন্ন অভিজাত মানুষের সীমিত গন্ডির গান ,তারপর তাঁর জন্মশতবর্ষে সে গান যেন আমাদের ভাসিয়ে দিল প্রবল প্লাবনে ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সংগীত সৃজন কে । তাঁর নিজের কথায়, ‘আমার গানের মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে দিনেদিনে সৃষ্টির শেষ রহস্য , ভালোবাসার অমৃত’ । তবুও আমরা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর গানের ‘ভালোবাসার অমৃত’ স্বাদ গ্রহণ করিনি তেমনভাবে, একথাও কবির অজানা ছিলনা । বাঙালি বিদ্যোৎসমাজে তাঁর গান নিয়ে মতান্তর বড় কম হয়নি । কবি আহত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর এই প্রত্যয় থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি যে ‘বাংলাদেশকে আমারগা্ন গাওয়াবোই’। সব আমি জোগান দিয়ে গেলুম ; ফাঁক নেই । আমার গান গাইতেই হবে – সবকিছুতেই’ সঙ্গীতবেত্তা দিলীপ কুমার রায় ও ধূর্জটি প্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে গান নিয়ে বহু তর্কাতর্কি করেছেন , সেকালের বাঙালি বিদ্যৎসমাজের দিকপাল ব্যক্তিত্ব রাধাকমল মুখপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন ‘দেশের বৃহৎ গ্রামসমাজের কাছে রবীন্দ্রসংগীত সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন, অবাস্তবসংশয় নেই যে মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বড় অংশের কাছেই গানের রবীন্দ্রনাথ অনাবিস্কৃত ছিলেন তাঁর প্রয়াণের দুইদশক পরেও । রবীন্দ্রনাথ প্রত্যুত্তর করেছিলেন প্রত্যয়ী ভাষায় ‘ আজকের সাধারণ মানুষ যাহা বুঝিলনা, কালকের সাধারণ মানুষ হয়তো তাহা বুঝিবে , অন্তত এইরূপ আশা করি’

দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালের চেয়ে সহস্র যোজন এগিয়েছিলেন বলেই জীবনের উপান্তে এসেও বলতে পেরেছিলেন “... যুগ বদলায় তার সবকিছু বদলায় । তবে সবচেয়ে স্থায়ী হবে আমার গান এটা জোর করে বলতে পারি ...। যুগে যুগে এই গাঙ তাকে গাইতেই হবে “।

রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন আর কেইবা নিজের সৃষ্টির প্রতি এমন স্থির বিশ্বাস ব্যক্ত করতে পারতেন ? তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর সুরের ধারায় অবগাহন করে পরিশুদ্ধ হয়ে চলেছি – চলবো আরো অনেক – অনেক দিন, হয়তো ততদিন পর্যন্ত – যতদিন বাঙালি জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে

রবি ঠাকুরের ছড়া / প্রবীর বিকাশ সরকার

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাকুম বাকুম ডাক 
পড়ছে মনে বটের ঝুরি জোড়াসাঁকোর বাঁক।
বৃষ্টি পড়ে পাতা নড়ে 
বালক মন কেমন করে 
স্মৃতির খাতায় এঁকে চলি পঁচিশে বৈশাখ।

চিরনূতনেরা দিল ডাক / অভিলাষা দাশগুপ্তা আদক

অনেক দিনের আগের কথা, লিখতে তবু চাই
যদিও জানি লেখনীতে সাধ্য বিশেষ নাই।
এক যে ছিলেন কবির কবি রবি কবিনাম
ছন্দে গানে গল্প কথায় ভুবনজোড়া নাম।

সেই সে কবে গেছেন চলে অস্তাচলে রবি
তবু আজও স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল তার ছবি।
আজও আমার মন খারাপে তাঁরই গান গাই
মায়ের গলায় তাঁর কবিতায় ছন্দ খুঁজে পাই।

প্রথম বাংলা পড়তে শেখা তাঁরই কলম ধরে
তাঁরই গল্প আজও আমার মন কে আকুল করে।
তাঁর আলেখ্য গীতিসুধায় মনে আবেশ হানে
বিশ্বকবির আসন যে তাই পাতা আমার মনে।

চিরনমস্য আমার প্রিয় কবির জন্মদিনে
এই অর্বাচীন শ্রদ্ধা জানায় কথার মালা বুনে।।

তোমার জন্য / তাপস দাশ
 জল পড়ে, পাতা নড়ে,
হে প্রাজ্ঞ, তারপর-
অধরা জীবন, ভালোবাসা-
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত।
বর্ষায় হয়েছো নদী,
বসন্তে খোয়াই ।

অন্তর্লীন সন্দিপক
তোমার জন্যই
আমার বিরহ বিলাস-
চন্দরা, বিনোদিনী।
রাঙ্গা মাটির পথে, তমাল তলে ভারতবর্ষ ।

বাইশে শ্রাবণ-
চোখের জলে রিক্ততা
সঁপেছি নিজেকে-
অমল বিশ্বাসে তোমার-
মানুষের প্রতি, বিশ্বাস হারানো পাপ ।


কবিগুরু স্মরণে / সুমিত রঞ্জন দাশ

মুর্খ বালক,
তুই রবীন্দ্রনাথ হতে চেয়েছিলি ...
তোর বুকজুড়ে সেদিনও ছিল জলতৃষ্ণা ঢেউ,
এক চুমুকে শুষে নিয়েছিলি মেয়েটার
শরীরব্যাপী লাজুক শ্রাবণ
বৃষ্টিবতী নারীর চোখে দেখেছিলি
আকাশ ভর্তি চাতক মেঘ

হাতের মুঠোয় ছিল অন্ধকার রাত
নগ্ন দেহের ভাষায় উন্মুক্ত ছিল 
নীল প্রজাপতির আনাগোনা ;
ওরা গান গাইতো, রবীঠাকুরের গান
ছায়া ছায়া নাচ নেচে 
তোরও কি বাহাত্তুরে ধরলো ?
অর্ধপেটা কাঁকড় চালে 
রঙীন অপেরার চন্দ্রাহত লাজ
একটা শব্দের আশায় তোর কাছে
দিনভর স্থির হয়ে থাকতো
উন্নত প্রজাতির উর্দিপরা অপ্সরা
বিলোতে চাইতো শ্রাবণ অরন্য

সে প্রেম প্রেম নয়
হাজারো ক্ষিধে ওর বুকে
হাজারো স্বপ্ন ওর মাথায়
একটা মাত্র শব্দ 
শুধু খোঁজে দুরের অসীম,
বুঝেছিলি কোনদিন সে শব্দের মানে ?
তার পায়ের মুদ্রায় ছিল নিষাদ ব্যস্ততা
বাতাসে দীর্ঘশ্বাসের হাওয়া ?
দেখিস তুই একদিন তার চোখের তৃষ্ণায়
মিশে যাবে জোৎস্নার কুচি
ধানিরঙ বসন্ত অন্ধকার দুরে সরিয়ে দেবে,
সেদিন রবীন্দ্রনাথ আর তোর মাঝে
থাকবে শুধু চন্দ্রতোয়া সেই নারী ,
বুকে জড়িয়ে ধরে বলবি -
আয় রবীন্দ্র বিরহে ব্যপ্ত হই দুজনে

তিন কন্যে / মৌ দাশগুপ্তা

আমাদের পাড়ার প্রবীণ কবির তিন মেয়ে
যাতায়াতের পথে দেখা হয়,
চোখাচোখি হতেই, লাজুক হাসি
আর গতানুগতিক কথোপকথন,
তিন বোন যেন তিন টুকরো কাহিনী।

বড় জন দীর্ঘাঙ্গী, শ্যামাঙ্গী সুন্দরী
অনেক পুরুষের বুকে কাঁপন ধরানোর মত রূপ ছিল তার ,
সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে বহু লোকের মন জুগিয়ে চলেছে,
জীবনের প্রথম ভালোবাসা
ভুল বোঝার স্রোতে সরে গেছে অনেক দূরে,
বহুভোগ্যা”-র দুর্নাম কুড়িয়ে একাকিনী কেঁদেছে,
অপমানিত, ক্লেদাক্ত হয়েছে বারবার
এই ভালমানুষ সাজা সমাজের কাছে,
কিন্তু চোখের জল মোছানোর মনের মানুষ”-টির খোঁজ আজও পায়নি,
আজও অভিমানী মেয়ের ক্লান্ত পদক্ষেপ আমার কবিতাকে ছুঁয়ে যায়।

মাঝেরটি গৌরাঙ্গী, তেজস্বিনী, প্রতিবাদী
দিদির মত নিরবে ভাগ্যের মার খাওয়ার পাত্রী সে মোটেও নয়,
বিয়ে হয়েছিল, ছেলেও আছে একটি,
কিন্তু ওই, অন্যায়কে মাথা নিচু করে মেনে নিতে পারেনি,
সুপুরুষ, বিখ্যাত স্বামীর পরনারী আসক্তি পছন্দ হয়নি,
প্রতিবাদে কাজ হয়নি যখন, তখন প্রতিকার আর কি হবে?
অতএব বিয়ের বন্ধন মনের বন্ধন হয়ে ওঠেনি,
স্বাধীনচেতা মেয়ে মাথায় সিঁদুরের ছাপ নিয়েই ফেরত এসেছে ,
মেয়ের চোখে আশার আলো, অনেক হারিয়েও জিতে যাবার স্বপ্ন,
অবাধ গতি মেয়ের চোখের পলকে তাই কবিতার ছন্দ দোলে।

তৃতীয় মেয়ে আত্মসুখী, আদরিণী, কুসুমকলি যেন
লাবণ্যে, লালিত্যে, সৌন্দর্যের বিভায় ঝলমলে ,
কিছুটা অবুঝ, আবেগে ভরপুর, ছটপটে, তবু স্বতন্ত্রে উজ্জ্বল,
বসন্তের ফুলের বনে মাতাল প্রজাপতির মতই উচ্ছল,
চেনা না চেনার দ্বন্দে দোলা মেয়ে তবু শঙ্কায় আবিল
দুই দিদির অভিজ্ঞতাতেই হয়তো সিঁদুরে মেঘ দেখতে পায়,
চোখে তাই জহুরীর দৃষ্টি, ভালোবাসাও বুঝি যাচাই করে নেবে
কিম্বা কষ্টিপাথরে ঘসে মেপে নেবে তার খাঁটি রঙ,
সন্দেহ মেয়ের পায়ের পাতায়, সংশয় মেয়ের আলতো ছোঁয়ায়,
তবু তাকে নিয়েই সুর বাঁধে আমার আজকের জীবনমুখী কবিতা।

ভালো কথা, বলতে ভুলে গেছি,
আমাদের পাড়ার প্রবীণ কবি, রবি বাবুর
তিন মেয়ের নামগুলোই তো এক একটি কাহিনীর উপক্রমণিকা,
ওরা তিন বোন - শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা আর কমলিকা...



শুধু তুমি আছো / সমীর ভট্টাচার্য

আমার বিনোদিনী রাইকিশোরী নেই, চন্দ্রাবলী নেই
জটিলা কুটিলা ললিতা বিশাখা রূপমঞ্জরী অনঙ্গমঞ্জরী নেই ।
শুধু তুমি আছো কবিগুরু
আমার বিষন্ন হৃদয় জুড়ে, করপুটে ফুটে ওঠা সকালের মত ।
আমার সহস্র ব্যথাময় পরিক্রমা আছে
আছে রাতের রূপমাধুরী
রেখে যাওয়া পাখীর পালক প্রচ্ছদ
আর আছো তুমি কবিগুরু ।


বুকের মধ্যে শুয়ে আছে শিষ্য কোন কুমারীর
আর্তনাদ অশেষ বৃষ্টি রক্ত শুধু গড়িয়ে যায় আমার দু’চোখে ।
আমার চন্দ্রাবলী নেই, বিনোদিনী রাইকিশোরী নেই...
আমিতো কখনো শপথ রাখিনি
কোন নদী বা শিবলিঙ্গের পাশে
কোন মেয়েকে বলিনি এই নাও ‘ঘরে বাইরে’
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব
কোন স্টেশনের ধারে ।
আমিতো খুজেছি বকুল গন্ধের মত
তোমার লিপিতে বচনে কাব্যে কুসুমটুকু ।

রবীন্দ্রনাথ / দিলীপ রায়

রবীন্দ্রনাথ, অনেক গান গাওয়া হলো, কবিতা পড়া হলো,
সাড়ে নটা বেজে গেল, যে যার
খিল তুলে নিজেদের গৃহের আশ্রমে, তারপর
সেই শয়ন, ভোজন, রমণ এবং বিশ্রাম ।
রবীন্দ্রনাথ, মাঝে মাঝে আমি খিদিরপুর ডকে যাই
সেখানকার শ্রমিকদের দেখলে আমার
তোমার কথা মনে পড়েনা, আমার
জেসাস ক্রাইষ্ট’এর কথা মনে পড়ে যায়


তারাও তো কেমন নিজেদের ক্রশ কাঠ কাঁধে
নিজেদের বধ্যভূমির দিকে যায় ।
রবীন্দ্রনাথ, অনেক গান গাওয়া হ’ল, কবিতা পড়া হ’ল
সাড়ে নটা বেজে গেল, যে যার
খিল দিয়ে দিল গৃহের আশ্রমে, তারপর
আবার সেই শয়ন, ভোজন, রমণ এবং এবং এবং ...

 
 “যে ভাষার ব্যকরণ সম্পূর্ণ হইয়াছে, সে ভাষার পরলোক প্রাপ্তি হইয়াছে । ব্যকরণ ভাষাকে বাঁচাইতে পারেনা ... ভাষার একটা ‘মমী’ তৈরি করে মাত্র । যে সাহিত্যে অলঙ্কার শাস্ত্রের রাজত্ব, সে সাহিত্যে কবিতাকে গঙ্গাযাত্রা করা হইয়াছে”।



“সংগীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়”